ধর্ম সকল সহিংসতার মূল— পশ্চিমা সেক্যুলার সোসাইটিতে প্রচলিত এই কমন মিথ, ঔপনিবেশায়নের কাল থেকে বর্তমান আধুনিক জাতিরাষ্ট্রের কাল পর্যন্ত পশ্চিমা সেক্যুলার-লিবারেলিজম এবং এর হালযামানার এক্সটেনশন নেশন-স্টেইটগুলোর অপশ্চিম সোসাইটিগুলোতে তাদের রাজনৈতিক-অর্থনৈতিক আধিপত্য ও সেক্যুলার সন্ত্রাসের অন্যতম বড় বৈধতাদানকারী ডিসকোর্স হিসেবে ব্যবহৃত হয়ে আসছে। পশ্চিমা একাডেমিয়া থেকে শুরু করে রাজনীতির মাঠ পর্যন্ত বিস্তৃত এই শক্তিশালী মিথ পশ্চিমা সেক্যুলারিজম নামক আধুনিক ধর্মের ঝাণ্ডাবাহী হিসেবে কাজ করে আসছে। ধর্মের প্রাইভেটাইজেশনে ব্যর্থ হওয়া অপশ্চিমা “সেকেলে”, “অনুন্নত”, “ইর্যাশনাল” দেশগুলোর উপর “ত্রাতা” হিসেবে পশ্চিমা লিবারেল-ডেমোক্র্যাসিকে চাপিয়ে দিতে পশ্চিমা লিবারেল-সেক্যুলার একাডেমিয়ার তৈরি করা এই মিথ, আধুনিক কালে এসে মুসলিম সোসাইটিগুলোতেও যথেষ্ট আবেদন সৃষ্টি করতে সমর্থ হয়েছে। বিশেষ করে সাম্প্রতিক সময়ে মুসলিম সোসাইটিগুলোতে পশ্চিমা আধিপত্যবাদের জন্য হুমকি হয়ে ওঠা রাজনৈতিক ইসলামকে এই মিথের বদৌলতে অযৌক্তিক ঘৃণা এবং সমস্যার সম্মুখীন হতে হচ্ছে।
পশ্চিমা ক্ল্যাশ অব সিভিলাইজেশনের ওয়ার্ল্ড ভিউ থেকে অপশ্চিম, বিশেষ করে মুসলমানদের “সন্ত্রাস” অযৌক্তিক, ধর্মান্ধতা, অনিয়ন্ত্রিত ও বর্বরোচিত, আর পশ্চিমের লিবারেল-সেক্যুলার সন্ত্রাস যৌক্তিক, নিয়ন্ত্রিত এবং কখনো কখনো ধর্মান্ধতাকে রুখতে “প্রয়োজনীয়”। ফলে আমেরিকাসহ পশ্চিমা বিশ্ব মুসলমান দেশগুলোতে দখলদারিত্ব ও গণ্যহত্যা জারি রেখেও তারা হয়ে ওঠে শান্তির দূত এবং মুসলমানরা হয়ে ওঠে সন্ত্রাসী। দুটি বিশ্বযুদ্ধসহ বিংশ শতাব্দীর সবচেয়ে বড় বড় যুদ্ধ, সহিংসতা, গণহত্যা, দখলদারিত্বের ইতিহাস থাকার পরেও সেক্যুলার সহিংসতা নয়, ধর্মীয় সহিংসতার মিথ জনপ্রিয় হয়ে ওঠে।
আমরা এই আর্টিকেল সিরিজে ধর্মীয় এই সন্ত্রাসের মিথকে এপিস্টেমিক্যালি (জ্ঞানতাত্ত্বিতকভাবে) ও এম্পিরিক্যালি (প্রায়োগিক/অভিজ্ঞতাবাদ দিয়ে) ভাঙতে চেষ্টা করবো। এই সিরিজে আমরা দেখবো, ১. “ধর্ম”কে কিভাবে এবং কি উদ্দেশ্যে আধুনিককালে সেক্যুলারিজমের প্রয়োজনীয় অন্য অপর হিসেবে তৈরি হয়েছে, ২. ধর্মের এসেনসিয়ালিস্ট সংজ্ঞা অনুসারে পশ্চিমা সেক্যুলার লিবারেলিজম, ক্যাপিটালিজম বা নেশন স্টেইটের মতো ন্যান্য সেক্যুলার ফেনোমেনাও কিভাবে ধর্ম হয়ে ওঠে ৩. ধর্মের উপর আরোপিত অভিযোগগুলো কিভাবে অন্যান্য সেক্যুলার মতবাদগুলোর ক্ষেত্রেও সত্যি, ৪. ধর্মীয় সন্ত্রাসের মিথ হয় কিভাবে গড়ে ওঠেছে এবং ৫. “ধর্মীয়” সহিংসতার এই মিথ কিভাবে সেক্যুলার জাতিরাষ্ট্রের সন্ত্রাসকে বৈধতা দান করতে করতে ব্যবহৃত হয়।
ধর্মের উত্থানঃ
ক্যাটাগরি হিসেবে “ধর্ম”— যা সকল কৃষ্টিক (cultural), রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক ইত্যাদি পার্থিব বিষয় থেকে মুক্ত আচারসর্বস্ব একটি বিশ্বাস— একটি আধুনিক পশ্চিমা আবিস্কার। পশ্চিমা ‘আলোকায়ন’ পূর্ববর্তী সময়ে কেবল আচার ও বিশ্বাসসর্বস্ব কোন ‘ধর্মের’ অস্তিত্ব ছিলোনা। বরং ইসলাম, ক্রিশ্চিয়ানিটির মতো ঐশী ‘ধর্ম’ ধর্মগুলো দ্বীন বা জীবনব্যবস্থা হিসেবে বিবেচিত হতো, অথবা প্রাচীন হিন্দু দর্শন বা গ্রিক religio সামাজিক-সাংস্কৃতিক দর্শন বা জীবনাচার হিসেবে গণ্য হতো। যেখানে দ্বীন হিসেবে ইসলাম বা ক্রিশ্চিয়ানিটি রাজনীতি, অর্থনীতি, সমাজনীতি, সমরনীতি ইত্যাদি কোন ক্ষেত্র থেকেই বিচ্ছিন্ন ছিলোনা; বরং সকল ক্ষেত্রেই তার দৃষ্টিভঙ্গি এবং প্রত্যক্ষ কর্তৃত্ব ছিলো। Wilfred Counwell Smith যেমনটা বলছেন যে, কৃষ্টি (Culture), রাজনীতিসহ জীবনের অন্যান্য ক্ষেত্র থেকে আলাদা ধর্ম মডার্ন পশ্চিমের তৈরি1।
ধর্মকে প্রয়োজনে বিভিন্ন সময় বিভিন্ন স্থানে ব্যবহার করার নিয়তেই ধর্মের উৎপত্তি। ক্যাটাগরি হিসেবে ধর্মের উৎপত্তির সাথে মডার্নিটি এবং সেক্যুলারিজমের ইতিহাস অঙ্গা-অঙ্গিভাবে জড়িত। Talal Asad তো ধর্মকে সেক্যুলারিজমের প্রয়োজনীয় অপর হিসেবে সৃষ্ট সংকর জমজ বলেছেন2। অর্থাৎ সেক্যুলারিজমকে প্রতিষ্ঠা করতেই ক্যাটাগরি হিসেবে ধর্মকে তৈরি করতে হয়েছে এবং সামগ্রিক ক্রিশ্চিয়ানিটিকে ভেঙে ধর্ম ও সেক্যুলারিজম নামক দুটি ভিন্ন পরস্পরবিরোধী ক্যাটাগরিতে ভাগ করা হয়েছে, যেখানে ক্রিশ্চিয়ানিটিকে ধর্মের মধ্যে বিলীন করে দেয়া হয়েছে। ফলে ধর্ম হিসেবে বিবেচিত আধুনিক ক্রিশ্চিয়ানিটি কেবল ধর্মীয় বিশ্বাস, রসম-রেওয়াজ, ইবাদত, নৈতিকতা (ক্ষেত্রবিশেষে তাও না) ইত্যাদি বিষয়ে দিকনির্দেশনা দিবে এবং কর্তৃত্বের অধিকার রাখবে; অন্যদিকে সেক্যুলারিজম সকল রাজনৈতিক, সামাজিক,অর্থনৈতিক সকল পার্থিব ও ক্ষমতাকেন্দ্রিক বিষয়গুলোর ব্যাপারে একচ্ছত্র কর্তৃত্ব করবে। ধর্মের ইতিহাসের দিকে তাকালে আমরা দেখতে পাই যে, প্রাক আধুনিক যুগে পৃথিবীর প্রায় কোন সভ্যতায়-ই আধুনিক ক্যাটাগরি/অর্থ হিসেবে ধর্মের (পার্থিব বিষয় থেকে মুক্ত) কোন অস্তিত্ব ছিলোনা। যেমনটা Smith আমাদের দেখাচ্ছেন যে, প্রাচীন রোমান, আযটেক, মিশরীয়, চৈনিক, ভারতীয় বা জাপানী সভ্যতায় আধুনিক ধর্মের প্রতিশব্দ হিসেবে ব্যবহৃত হয় এমন কোন শব্দ ছিলোনা। রোমান সভ্যতায় ব্যবহৃত ল্যাটিন Religio টার্মটি সামাজিক দায়িত্ব ও আচার পালনের জন্য প্রয়োজনীয় শর্তাবলিকে বুঝানো হতো। (William T Cavanaugh) এই দায়িত্ব ও আচারের মধ্যে এমনসব পারিবারিক, রাজনৈতিক, সামাজিক বিষয় অন্তর্ভূক্ত থাকতো, যাকে আধুনিক সময়ে সেক্যুলার আচার বলে ধরে নেওয়া হয়। S.N. Balagangadhara এর মতে, রোমান সভ্যতায় religio বলতে রোমান সামাজিক শৃঙ্খলার বজায়ের স্বার্থে আচরিত রীতি এবং প্রথাকে বুঝানো হতো, যা ধর্মতত্ত্বীয় বিশ্বাস/মতবাদের ব্যাপারে উদাসীন ছিলো62।
আমরা যদি পশ্চিমে ধর্মের উত্থানের ইতিহাসের দিকে তাকাই, তাহলে দেখি যে আধুনিক কালের আগ পর্যন্ত ক্রিশ্চিয়ানিটি এবং ধর্ম একটা আরেকটার সমার্থক ছিলো না। ক্রিশ্চিয়ানিটির মধ্যযুগ (১১০০-১৪৫৩ সাল) নিয়ে Smith এর বক্তব্য হচ্ছে, “Religion” এর উপরে কোন বই লেখা হয়নি এ সময়টাতে, যদিও এই সময়টাকে সবচেয়ে বেশি ধার্মিকতার সময় হিসেবে দেখা হয়।৬৪ আধুনিককালে রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক, সামাজিকসহ পার্থিক বিষয় থেকে মুক্ত ক্যাটাগরি হিসেবে ধর্মের প্রথম আত্মপ্রকাশ ঘটে পশ্চিমা আধুনিকায়নের কালে পশ্চিমা একাডেমিয়ায়, যা পাবলিক স্ফিয়ার থেকে চার্চের পতনের মাধ্যমে পূর্ণতা পায়। Jonathon Z. Smith তার Imagining Religion: From Babbylon to Jonestwon বইয়ে বলছেন, “ধর্ম নিছকই পান্ডিত্যপূর্ণ অধ্যয়নের (Scholarly studies) একটি সৃষ্টি। … একাডেমিয়ার বাইরে এই স্বতন্ত্র কোন অস্তিত্ব নেই।”৫৮ ধর্মের উত্থানের আগ পর্যন্ত ক্রিশ্চিয়ান সোসাইটিতে চার্চ ছিলো সকল সামাজিক, রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক ক্ষমতার কেন্দ্রবিন্দু। Cavanaugh এর মতে, রেঁনেসার কালে সেক্যুলারাইজেশনের মাধ্যমে ধর্মের সৃষ্টিতে প্রথম ভূমিকা রাখেন ১৫ শতকের Nicholas of Cusa এবং Marsilo Ficino, যারা প্রথমে religio নামক পরিভাষা ব্যবহার করেন কে মানুষের আত্মিক ও আভ্যন্তরীন বিষয়কে ব্যাখ্যা করতে। তারপর ১৬ শতকে মার্টিন লুথারের নেতৃত্বে শুরু হয় রিফরমেশন, যেখানে লুথার ক্রিশ্চিয়ানিটিকে আত্মিক বিশ্বাস এবং কনফেশনের মধ্যে সীমাবদ্ধ করার চেষ্টা করেন্ন। লুথার রিফরমেশনের আন্দোলনের পর্যায়ক্রমে ক্যাথোলিক চার্চ এবং তার ক্ষমতাকাঠামো ও কর্তৃত্বের বিরোধিতা করেন; বরং রাজা এবং প্রিন্সদেরকে সামাজিক ও রাজনৈতিক ক্ষমতার একমাত্র অধিকারী হিসেবে দাবি করেন। ১৭শ শতকে এসে প্রিন্টিং প্রেসের কল্যান ক্যাথোলিক, প্রোটেস্ট্যান্টদের পাল্টাপাল্টি বই, প্রচারপত্র ইত্যাদির প্রচারের ফলে Religion/ধর্ম শব্দটি প্রথমবারের মতো বহুলভাবে ব্যবহৃত হতে শুরে করে। এসময় ধর্ম বলতে সাধারনত ক্রিশ্চিয়ানিটির বিভিন্ন উপগ্রুপকে ক্যাটাগরাইজ করা হতো। Boosy এর মতে, এই সময়ে এসে ক্রিশ্চিয়ানিটি ধীরে ধীরে ধর্মীয় মতবাদ অর্থে ব্যবহৃত হতে শুরু করে। ৭৪ ১৭ শতকের য়্যুরোপ যে বিশাল রাজনৈতিক পট পরিবর্তনের মধ্য দিয়ে যায়, সেই পরিবর্তনের তাত্ত্বিক ভিত তৈরিতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা ছিলো John Locke, Thomas Hobbes, J J Rosseau এর মতো ব্যক্তিদের। রিফর্মেশন ও ‘ধর্মযুদ্ধের’ পথ পরিক্রমায় চার্চের ক্রমশ কর্তৃত্বহীন হয়ে ওঠার মধ্য দিয়ে য়্যুরোপে জন্ম হয় আধুনিক রাষ্ট্রের। আধুনিক রাষ্ট্রে সকল কর্তৃত্বের কেন্দ্র ও অধিকারী হয়ে ওঠে রাষ্ট্র, যা আগে ছিলো ক্রিশ্চিয়ান চার্চের হাতে। চার্চের কর্তৃত্বহীনতা ও রাজনৈতিক-সামাজিক ক্ষমতার এ পালাবদলে চার্চা তথা ধর্ম তথা ক্রিশ্চিয়ানিটির ভূমিকা সীমাবদ্ধতা হয়ে পড়ে ব্যক্তিক পর্যায়ে, ধর্ম হয়ে ওঠে মানুষের একান্তই ব্যক্তিগত একটা ব্যাপার। এসময় ধর্মের এ প্রাইভেটাইজেশনে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখেন John Locke। লক ধর্মকে ব্যক্তির আত্মিক অবস্থা হিসেবে উল্লেখ করেন।৭৮ তিনি রাষ্ট্র এবং চার্চের ক্ষমতা ও কাজের সীমা আলাদা হওয়ার প্রয়োজনীয়তা উল্লেখ করেন; যেখানে রাষ্ট্র পাবলিক তথা বৈষয়িক বিষয়ের দেখভাল করবে এবং চার্চ প্রাইভেট তথা আত্মিক বিষয়ের দায়িত্ব পালন করবে। লক চার্চের সামাজিক ও রাজনৈতিক কর্তৃত্বকে অস্বীকার করেন; তার মতে বরং রাষ্ট্রই একমাত্র এসকল ক্ষমতার অধিকারী এবং রাষ্ট্রের প্রতি নাগরিকের আনুগত্য বাধ্যতামূলক। লকের ভাষায়, এমনকি রাষ্ট্র তার নাগরিক স্বার্থে যে কোন সময় সহিংস হওয়ার অধিকার রাখে এবং পক্ষান্তরে, চার্চের কোন বলপ্রয়োগের অধিকার নেই এবং চার্চের প্রতি আনুগত্য ব্যক্তির ইচ্ছাধীন। লক প্রমুখদের ধর্মকে ব্যক্তিকীকরণের এই প্রচেষ্টা ১৬শ এবং ১৭শ শতকের য়্যুরোপিয়ান রাজনৈতিক পট পরিবর্তনে জন্ম নেওয়া প্রতাপশালী রাষ্ট্র এবং আলোকায়ন ও তার পরিক্রমায় ব্যক্তি-স্বাতন্ত্র্যবাদ/অধিকার, আধুনিকতা, লিবারেলিজমের হাত ধরে সফলতার মুখ দেখে। এভাবে ধর্মের রাজনৈতিক শূণ্যস্থান পূরণে নতুন জীবন বিধান হিসেবে জন্ম হয় ধর্মের অপর প্রয়োজনীয় জমজ সেক্যুলারিজমেরও। আর ক্রিশ্চিয়ানিটির রাজনৈতিক হাকেমিয়াত সেক্যুলারিজমের কাছে হাতবদল হওয়ার মধ্য একাডেমিয়ায় তৈরি এই ‘ধর্ম’ পরিভাষাটি ধীরে ধীরে পশ্চিমে কমন একটা পরিভাষা হয়ে ওঠে, যার হাকেমিয়াতের সীমানা হয়ে ওঠে শুধুমাত্র বিশ্বাসকেন্দ্রিক মতবাদ এবং ইবাদত।(81-83)
পশ্চিমের বাইরে পশ্চিমের কলোনিগুলোতে ধর্মের জন্মের ইতিহাস আরো করুণ। সেইসব কলোনিগুলোতে ধর্মকে আবিস্কার করা হইছে তাদের উপর রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক কর্তৃত্বকে আরো শক্তিশালী করতে এবং স্থানীয় কৃষ্টি ও আচারগুলোকে দমিয়ে রাখতে— যেটা বলছেন Cavanaugh. ক্যাভানগ অন্যান্য স্কলারদের বরাতে দেখাচ্ছেন যে, য়্যুরোপিয়ান কলোনাইজাররা কিভাবে দক্ষিণ আমেরিকা থেকে আফ্রিকা, এশিয়া, প্রশান্ত সাগরীয় দ্বীপগুলোতে তাদের কলোনি স্থাপনের কালে স্থানীয়দের কোন “ধর্ম” আছে বলে অস্বীকার করেছে। অতপর যখন সেই অঞ্চলগুলো দখল করে কলোনি স্থাপন করার পরই তারা অদ্ভুতভাবে প্রত্যেক স্থানীয় লোকদের ‘ধর্ম’কে আবিস্কার করে। David Chadister এর মতে, স্থানীয়দের মাঝে ক্যাটাগরি হিসেবে “ধর্মের” প্রবর্তন আসলে তাদের সামাজিক নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠার একটা কৌশল ছিলো।৮৬ কারণ, কলোনাইজাররা যখনি স্থানীয়দের ধর্মকে “আবিষ্কার” করলো, তারা সেইসব ধর্মগুলোকে আবিষ্কার করলো একেকটা “আদিম”(primitive) ধর্ম হিসেবে। আমরা যদি ভারতীয় উপনিবেশ আমলের হিন্দু ধর্মের উদাহরণের দিকে দেখি, তাহলে Smith এর ভাষায়, ১৮২৯ সালের আগে Hinduism নামে ধর্মের অস্তিত্ব ছিলোনা। এমনকি “হিন্দু” পরিভাষাটিও প্রাচীন ভারতে প্রচলিত ছিলোনা। প্রাচীন ভারতে মানুষের জীবনের লক্ষ্য ও কর্মের (পুরুষার্থ) বলতে চারটা জিনিসকে ববুঝানো হতো— কাম (কামা), আর্থ (আর্থা), ধর্ম (ধার্মা)ও মোক্ষ (মুকশা)। মানুষ আনন্দ-ফুর্তির জন্য যা করতো তাকে বলা হতো কাম। সম্পদ ও আয়-উপার্জনের মাধ্যম হচ্ছে অর্থ। আর ধর্ম বলতে বুঝানো হতো মানুষের জীবনের চলার পথে সকল দায়িত্ব ও কর্তব্য। আর মোক্ষ হচ্ছে এসবের মধ্য দিয়ে মানুষের মুক্তি। প্রাচীন ভারতে ধর্ম পরিভাষাটির মধ্যে অন্তর্ভূক্ত ছিলো সকল ধরনের সামাজিক রীতি-নীতি, অধিকার, কর্তব্য, লোক আইন, মন্দিরের উপাসনা ইত্যাদি সব। ৮৮ অর্থ্যাৎ, মানুষের জীবন ও সমাজ পরিচালনার ভিত্তি বা বিধান ছিলো এই ধর্ম; এটা নিছক কোন পূজা-উপসনা বা বিশ্বাসের ব্যাপার ছিলোনা। আর এই পুরুষার্থ হিন্দুইমের কোন ধারণা ছিলোনা, যেহেতু হিন্দুধর্ম বলতে কোন ধর্মই ছিলোনা; বরং এটা ছিলো প্রচীন ভারতীয় সমাজের জীবন দর্শন। ফলে বৌদ্ধ, জৈন ইত্যাদি ভারতীয় ধর্মগুলোতেও এই ধারণাগুলোর অস্তিত্ব পাওয়া যায়। Balagangadhara এর মতে, ভারতীয় মুসলমানরা হিন্দু বলতে আসলে ভারতের অমুসলিমদের বুঝাতো- যার মধ্যে ছিলো আধুনিককালের হিন্দু, বৌদ্ধ, শিখ, জৈন সবাই অন্তর্ভূক্ত ছিলো। ৮৭
তারপর ব্রিটিশরা এদেশে কলোনি গেঁড়ে বসার পর হুট করে আলাদা ‘ধর্ম’ হিসেবে হিন্দু, বৌদ্ধ, জৈন, শিখ ইত্যাদির উত্থান হলো। কিন্তু কেন এসব ধর্ম সৃষ্টির প্রয়োজন পড়লো এ প্রশ্নের উত্তর দিতে গিয়ে ক্যাভানগ দেখাচ্ছেন যে কিভাবে ধর্ম হিসেবে হিন্দু ধর্মের উত্থান বৃটিশদের উপনিবেশায়ন ও রাজনৈতিক-সামাজিক কর্তৃত্ব স্থাপনে ভূমিকা রেখেছিলো। প্রথমত, ধর্ম হিসেবে হিন্দুইজমের উত্থান ব্রিটিশ উপনিবেশায়নের প্রধান শত্রু এ অঞ্চলের মুসলমানদের একটি প্রতিপক্ষ বা শত্রু তৈরি করতে সমর্থ হলো। অর্থ্যাৎ, এর ফলে একটা ধর্মগোষ্ঠী হিসেবে হিন্দুরা মুসলমানদেরকে ঐতিহাসিক শত্রু হিসেবে গণ্য করতে শুরু করলো এবং ব্রিটিশদের সহযোগিতায় তারা মুসলমানদের বিরুদ্ধে শত্রুভাবাপন্ন আচরণ ও কর্মকান্ড চালিয়ে যেতে লাগলো। ব্রিটিশদের সহায়তার মুসলমানদের উপর হিন্দুদের এই কর্তৃত্ব/নিপীড়ন উপনিবেশায়নের প্রধান শত্রু মুসলমানদেরকে দুর্বল রাজনৈতিক ও সামাজিক প্রভাবকে দুর্বল করতে সাহায্য করে। দ্বিতীয়ত, হিন্দু ও অন্যান্য ধর্মের উত্থানের ফলে জনমানসে একটা ধর্মতাত্ত্বিক বিভাজন সৃষ্টি হয় এবং এর ফলে উপনিবেশ বিরোধী আন্দোলনের গুরুত্ব ধর্মীয় বিভাজন, সংঘাতের (কম্যুনালিটি বোধ) কারণে স্বাভাবিকভাবেই ক্ষতিগ্রস্থ হয়। তৃতীয়ত, একটা বিশ্বাসসর্বস্ব ধর্মীয়বোধের উত্থান উপমহাদেশে ধর্মের রাজনৈতিক, সামাজিক, কৃষ্টিক উপযোগিতাকে নাই করে দিয়ে ধর্মকে প্রাইভেট বা ব্যক্তিক জীবনে সীমাবদ্ধ করার চেষ্টাকে সফল করলো।
ধর্মকে প্রাইভেটাইজেশনের এ প্রক্রিয়ায় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখেন James Mill এর মতো ভাড়াটে ইতিহাসবিদেরা। তাদেরকে ভাড়া করা হয়েছিলো এইসব বলার জন্য যে, ভারতীয় সমাজে ধর্মের আধিপত্য এবং ধর্মকে রাজনীতি থেকে আলাদা করতে না পারা যে ভারতীয়দের ‘অযুক্তিবাদী মানসিকতা’র (irrationality) প্রমাণ। ফলে ভারতীয়দের সভ্য হয়ে উঠতে হলে ধর্মকে রাজনীতির ময়দান থেকে আলাদা করতে হবে। আর এই ‘অসভ্য’ ভারতীয়দের এই ‘সভ্য’ করার মহৎ-উদার দায়িত্ব নিতে হলো ব্রিটিশদেরকেই। Ronald Inden এর ভাষায়, এভাবে ব্রিটিশ সাম্রাজবাদীরা এই হিন্দু ভারতের এই কাল্পনিক ‘নন-র্যাশনাল’ স্বরুপকে ‘র্যাশনাল’ করার বার্ডেন অনুভব করলো। আর র্যাশনালিটি আরোপ করার মাধ্যমে তারা বস্তুত ধর্মীয় ব্যপারেই নয়, পুরো ব্রিটিশ ভারতের সামগ্রিক বিষয়ের উপর কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠা করলো। ৯১ ক্যাভানগ আরো সুন্দর করে তুলে ধরেছেন যে, ব্রিটিশ ভারতে ব্রিটিশ হওয়া ছিলো পাবলিক একটা বিষয়, আর ভারতীয় হওয়ার ছিলো প্রাইভেট বিষয়। অর্থ্যাৎ মানুষ বাইরে (অফিস, আদালত, রাস্তাঘাটে) ব্রিটিশ কালচার ও মূল্যবোধকে ধারণ করবে, আর ভারতীয় কালচার থাকবে ঘরের ভেতর। ধর্মের এই প্রাইভেটাইজেশন ভারতীয় স্থানীয় কৃষ্টি, এমনকি খোদ ভারতীয়দেরই ক্ষমতার ময়দান থেকেই দূরে সরিয়ে দেয়। ৯১
ব্রিটিশ ভারতে বৌদ্ধ, জাপানে শিনিতো বা চীনের কনফুসিয়ানিজম নামক ধর্মের জন্ম পুরানও হিন্দুইজমের মতই। আর আফ্রিকান ও আমেরিকান কলোনিগুলোতে তো পশ্চিমা ঔপনিবেশিকেরা নিজেদের নতুন ধর্ম হয়ে ওঠা ক্রিশ্চিয়ানিটিকে পুরোপুরি চাপিয়ে দিয়েছে। আফ্রিকান ও আমেরিকান নিজস্ব সংস্কৃতি, মূল্যবোধ, রসম-রেওয়াজ প্রায় পুরোপুরি ক্রিশ্চিয়ানিটি দিয়ে প্রতিস্থাপিত হয়েছে। আর এই আধুনিক ধর্ম ক্রিশ্চিয়ানিটির সাথে সাথে সেখানে স্বাভাবিকভাবেই পশ্চিমা সেক্যুলারিজমও প্রতিষ্ঠিত হয়েছে, কারণ ধর্ম হিসেবে আধুনিক ক্রিশ্চিয়ানিটির উত্থানের বাই-প্রোডাক্টই হলো সেক্যুলারিজম; ফলে সেক্যুলারিজম আধুনিক ক্রিশ্চিয়ানিটির সাথে গলাগলি করে সহাবস্থান করে। আর বলার অপেক্ষা রাখেনা যে, এই ধর্ম ও সেক্যুলারিজমের উত্থানের প্রভাব মুসলমান কলোনিগুলোতেও পড়েছিলো। মুসলমান ভূখন্ডে পশ্চিমাদের কলোনি স্থাপনের মুসলমান কলোনিগুলোতে সামগ্রিক জীবনদর্শন বা দ্বীন হিসেবে প্রতিষ্ঠিত থাকা ইসলামকেও ধীরে ধীরে ধর্মের ট্যাগ দেওয়া হলো— যার কোন রাজনৈতিক, সামাজিক, কৃষ্টিক উপযোগিতা থাকতে নেই। আর আধুনিক মুসলমান রাষ্ট্রগুলো এখনো এই বিষফোঁড়াকে বয়ে বেড়াচ্ছে।
সুতরাং পরিভাষা হিসেবে ধর্মের উত্থানের ইতিহাস থেকে এটাই স্পষ্ট হয় যে, পশ্চিমা বিশ্বে এ পরিভাষাটিকে সৃষ্টি করা হয়েছে ধর্মকে প্রাইভেট স্ফিয়ারে বন্দী করার মাধ্যমে সেক্যুলারিজমের উত্থানের পথকে সুগম করতে। অর্থ্যাৎ, য়্যুরোপে ধর্মের উত্থানের মাধ্যমেই সেক্যুলারিজমের সৃষ্টি হয়ছে এবং ধর্ম ও সেক্যুলারিজম একে অপরের পরিপূরক হিসেবে য়্যুরোপের রাজনৈতিক-সামাজিক ক্ষমতাকাঠামোকে নির্মাণ করেছে। অপরদিকে ইয়্যুরোপিয়ান কলোনিগুলোতে ধর্ম পরিভাষাটি প্রথমত তাদের রাজনৈতিক-সাংস্কৃতিক হাকেমিয়াত তথা উপনিবেশায়নকে প্রতিষ্ঠিত করতে ব্যবহৃত হয়ছে। দ্বিতীয়ত, উপনিবেশায়িত অঞ্চলের ধর্মগুলোকে ইরর্যাশনাল আখ্যা দিয়ে সেক্যুলারিজমকে (অথবা ক্রিশ্চিয়ানিটি এবং সেক্যুলারিজম) প্রতিষ্ঠিত করতে ব্যবহৃত হয়েছে।
ধর্মের সংজ্ঞায়ন ও জ্ঞানতাত্বিক দ্বিচারিতা
পশ্চিমা ধর্ম ও সন্ত্রাসের জ্ঞানতাত্ত্বিক অধ্যয়নের অন্যতম বড় দুর্বলতা হচ্ছে, ধর্মকে নির্দিষ্টভাবে সংজ্ঞায়ন করতে না পারা। ধর্মীয় সন্ত্রাস নিয়ে কাজ করা ও ধর্মীয় সন্ত্রাসের মিথকে জনপ্রিয় করা স্কলারগণ এখন পর্যন্ত ধর্মের নির্দিষ্ট কোন সংজ্ঞায় একমত হতে ব্যর্থ হন।১৬ বরং ধর্মীয় সহিংসতা নিয়ে কাজ করা পশ্চিমা স্কলারগণ এই মিথের প্রয়োজনে ধর্মের ভিন্ন ভিন্ন সংজ্ঞা হাযির করেছেন এবং নিজেদের সুবিধা অনুযায়ী বিভিন্ন ট্র্যাডিশনাল বিশ্বাস ও দ্বীনকে এই ধর্মের বৃত্তবন্দী করেছেন অথবা প্রয়োজনে এই লিস্ট থেকে বাদ দিয়েছেন। এমনকি অনেক স্কলার ধর্মীয় সন্ত্রাসের মিথ নিয়ে আলোচনার সময় ধর্মের কোন সংজ্ঞা দেওয়ারই প্রয়োজন বোধ করেন না। ধর্মীয় সহিংসতা নিজে কাজ করা গুরুত্বপূর্ণ এক পন্ডিত Charles Kimball তো ধর্মের নির্দিষ্ট সংজ্ঞা দিতে ব্যর্থ হয়ে বলেই দিয়েছেন যে, ধর্মকে “আমরা সবাই বুঝি, যখন আমরা একে দেখি।” ৫৮
তারপরেও পশ্চিমা একাডেমিয়ায় ধর্মীয় অধ্যয়ন শাখায় ধর্মের সংজ্ঞা নির্ধারণে আমরা দুই ধরনের এপ্রোচ দেখতে পাইঃ সাবস্ট্যান্টিভিস্ট (Substantivist) এপ্রোচ এবং ফাংশনালিস্ট (Functionalist) এপ্রোচ। সাবস্ট্যান্টিভিস্ট এপ্রোচ হলো, যেখানে ধর্মকে মানুষের বিশ্বাস/মতবাদের ভিত্তিতে সংজ্ঞায়িত করা হয়। এ ধারার স্কলারগণ সাধারনত ইশ্বর বা স্রষ্টার ধারণা দিয়ে ধর্মকে সংজ্ঞায়িত করে থাকেন। এই সংজ্ঞায়নের সীমাবদ্ধতা হলো, যেহেতু শুধুমাত্র ইশ্বরে বিশ্বাসকে ধর্মের শর্ত ধরলে এতে বৌদ্ধ, কনফুসিয়ানিজম ইত্যাদি ধর্মের বৃত্ত থেকে আলগা হয়ে যায়, তাই অনেক স্কলার ইশ্বরের ধারণার বদলে transcendence (মনুষ্যত্বের নির্যাস খোদা/দৈব-মানব সম্পর্ক থেকে উৎসরিত হওয়ার ধারণা) এর ধারণা থাকাকেই ধর্ম হওয়ার শর্ত হিসেবে দেখেন। কিন্তু transcendence এর ধারণাকে ধর্ম হওয়ার শর্ত হিসেবে দেখার সমস্যা হলো, transcendence একটা অস্পষ্ট ধারণা।১০৩ এর দ্বারা অনেক কিছু বুঝানো যেতে পারে, ধর্মীয় এবং সেক্যুলার দৃষ্টিভঙ্গি অনুযায়ী এর সংজ্ঞায়নও ভিন্ন হতে পারে; এমনকি অনেক সেক্যুলার ফেনোমেনাকেও এই ধারনা দিয়ে ব্যাখ্যা করা যায়। যেমনটা Thimothy Fitzgerald বলছেন যে, ট্রান্সেন্ডেন্স এর ধারণাকে যদি ধর্মের শর্ত হিসেবে ধরা হয় তাহলে জাতি (Nation), দেশ, হিউম্যানিজম, কম্যুনিজম, ডেমোক্র্যাসি, মানবাধিকার, আলোকায়ন থেকে শুরু করে অনেক মডার্ন-সেক্যুলার ফেনোমেনাকেই ধর্মের অন্তর্ভূক্ত করতে হয়।১০৩ সাবস্ট্যান্টিভিস্ট ধারার অনেক স্কলার আবার (যেমন Brain Morris) আবার ধর্ম ও সেক্যুলারিজমকে সংজ্ঞায়িত করতে বাস্তবতাকে বিশ্লেষণের ডাইকোটমি দিয়ে বিচার করেন, যেমন- “এম্পিরিক্যাল/সুপ্রাএম্পিরিক্যাল”, “ন্যাচারাল/সুপারন্যাচাল”, “হিউম্যান/সুপারম্যান” ইত্যাদির দ্বৈত ধারনা। তাদের মতে যেখানে বাস্তবতাকে “এম্পিরিক্যালি” ব্যাখ্যা করা যায়; যে মতবাদ কেবলমাত্র ন্যাচারাল, হিউম্যানলি ধারনার উপর নির্ভর করে— সেগুলো সবই সেক্যুলার। কিন্তু যে বাস্তবতাকে “এম্পিরিক্যালি” ব্যাখ্যা করা যায়না; সুপারন্যাচারাল বা সুপারহিউম্যানের ধারনা যে মতবাদে বিদ্যমান সেগুলো ধর্ম। কিন্তু এই ধরনের সংজ্ঞায়নও প্রবল সমস্যাজনক। Fitzgerald এর ভাষায়, সকল মূল্যবোধ (values) সুপ্রাএম্পিরিক্যাল; তা হোক মানাবাধিকার বা স্বাধীনতা (Freedom) এর মতো সেক্যুলার ভ্যালুগুলো কিংবা পাপ-পূণ্যের মতো ধর্মীয় মূল্যবোধগুলো।১০৪
এবার আমরা যদি ফাংশনালিস্ট সংজ্ঞার দিকে তাকাই, তাহলে এই এপ্রোচও যে কতটা স্ববিরোধী তা স্পষ্ট হয়। এই এপ্রোচে ধর্মকে তার বিশ্বাস বা মতবাদের বদলে সেটা সোসাইটিতে কিভাবে ফাংশন করে তার উপর ভিত্তি করে সংজ্ঞায়িত করা হয়। ধর্মের এই ফাংশনালিস্ট সংজ্ঞা প্রথম নিয়ে আসেন Emile Dhurkheim। ডুর্খেইম ধর্মকে মূলত পবিত্র-অপবিত্র/তুচ্ছ (Sacred-profane/mundane) কনসেপ্টের অস্তিত্বের ভিত্তিতে সংজ্ঞায়িত করেন। ডুর্খেইমের মতে, ধর্ম হচ্ছে এমন কোন বিশ্বাস-মতবাদ বা আচারের সমষ্টি, যাতে পবিত্রতার কনসেপ্ট আছে, অর্থাৎ কিছু বিষয়কে সেই মতবাদে অত্যন্ত পবিত্র মনে করা হয়; সেই সাথে ধর্মে নির্দিষ্ট কিছু বস্তু বা কাজকে নিষিদ্ধ/অপবিত্র হিসেবে গণ্য করা হয়। ১০৬ যেমন, আমরা যদি ইসলাম থেকে উদাহরণ দেই, তাহলে কুরআন, কা’বা ইত্যাদি ইসলামের পবিত্র বিষয়; ব্যাভিচার, মদপান ইত্যাদি নিষিদ্ধ আচার, শুকরের মাংস অপবিত্র বস্ত ইত্যাদি। ফাংশনালিস্টদের কাছে কোন মতবাদকে ধর্ম হয়ে ওঠার জন্য সে মতবাদে এরকম পবিত্র/অপবিত্রতার ধারণা থাকতে হবে। ডুর্খেইমের কাছে ধর্মের আরেকটা সংজ্ঞা হচ্ছে, ধর্মের সামাজিক ফাংশন হিসেবে এটা সমাজে একই সাথে একতা এবং বিভাজনের কনসেপ্ট হিসেবে কাজ করে। একই সাথে ধর্ম সোশ্যাল কন্ট্রোলের মাধ্যম হিসেবেও ব্যবহৃত হয়। ডুর্খেইম বা অন্যান্য ফাংশনালিস্টদের উপরোক্ত দুটো সংজ্ঞায়ন এম্পিরিক্যালি অনেক শক্তিশালি হলেও এর সীমাবদ্ধতা হলো, এই সংজ্ঞা অনেক সেক্যুলার মতবাদ বা প্র্যাকটিসকেও ধর্মের অন্তর্ভূক্ত করে ফেলে। যেমন, আমরা যদি পবিত্র-অপবিত্রের ধারণাকে মেনে নিয়ে সেক্যুলার নেশন স্টেইটের দিকে তাকাই, তাহলে দেখবো যে নেশন স্টেইটে পতাকা এবং জাতীয় সংগীত অনেক ধর্মের টোটেমের চেয়েও বেশি স্পর্শকাতর ও পবিত্র বিষয়। এর যেকোন একটার অবমাননা কিংবা সম্মান জানাতে অস্বীকৃতি সেক্যুলার-রাষ্ট্রীয় ব্লাসফেমি হিসেবে গণ্য হয়। অথবা অনেক জাতিরাষ্ট্রের “জাতির পিতা” ধারনা ধর্মের নবীর ধারনার মতই পবিত্র ও স্পর্শকাতর।
আবার ধর্মের সামাজিক ফাংশনের সংজ্ঞাকে মেনে নিয়ে আমরা যদি ন্যাশনালিজমের দিকে তাকাই, তাহলে দেখি যে, একটা ভূখন্ডে আধুনিক ন্যাশনালিজম ধর্মের চেয়েও বেশি মারাত্মকভাবে একতা এবং বিভাজনের ডিসকোর্স হিসেবে কাজ করে। একইভাবে, এই সংজ্ঞা অনুসারে ভোক্তাবাদ (Consumarism), গণতন্ত্র, মার্ক্সবাদ, এমনকি অর্থনীতি, রাজনীতি ইত্যাদিও ধর্ম হিসেবে বিবেচিত হওয়ার যোগ্য। Fitzgerald বিভিন্ন ধর্মতত্ত্বের স্কলারদের উদাহরণ এনে আমাদের দেখাচ্ছেন যে, তারা কিভাবে টোটেম, ক্রিসমাস কেইক, ব্ল্যাক ম্যাজিক থেকে শুরু করে জাতীয়তাবাদের ধারনা, মানবাধিকার, মার্ক্সিজম, সামন্তবাদ, এথিক এর মতো সেক্যুলার ধারনা ও মতবাদগুলোও ধর্ম হিসেবে সংজ্ঞায়িত করেছেন। ১০৭ যেমন ধর্মবিদ Darothe Solle বলেছিলেন, “কনজ্যুমারিজম হল নতুন ধর্ম।”১০৭ সোলের এই পর্যবেক্ষণকে Russell Belk, Melanie Wallendorf, and John Sherry এর গবেষকগণ সত্য হিসেবে প্রমাণ করেছেন।১০৭ Herbert Schaneider হিউম্যানিজমকে ধর্ম হিসেবে আখ্যায়িত করেছেন। David Loy বলছেন যে, ধর্মের ফাংকশালিস্ট সংজ্ঞাকে মেনে নিলে ইকোনোমিক সিস্টেমকেও ধর্ম হিসেবে গণ্য করতে হয়। লয়ের ভাষায়, ইকোনমিক্স হচ্ছে এই ধর্মের ধর্মীয় মতবাদ আর মার্কেট (Market) হচ্ছে তার ইশ্বর। ১০৮
আবার রাজনীতি কিভাবে ধর্ম হয়ে ওঠে Emilio Gentile তার Politics as Religion বইয়ে সে সম্পর্কে বিস্তারিত আলোচনা করেছেন। Gentile বলছেন যে, ““রাজনীতির ধর্ম (Religion of Politics) একটি ধর্মীয় ব্যাপার; কারণ রাজনীতি হচ্ছে বিশ্বাস, মিথ, আচার এবং প্রতীকের (symbol) সম্মলিত এক ব্যবস্থা, যা রাষ্ট্র নামক সর্বোচ্চ একটা অস্তিত্বের প্রতি মানুষের আনুগত্যের মাধ্যমে মানুষের ব্যক্তিক ও সামষ্টিক নিয়তিকে বিলীন করে দেয়, এবং এইভাবে মানুষের জীবন অস্তিত্বহীনতার মাধ্যমে “অর্থবহ” হয়ে ওঠে।”” [প্যারাফ্রেইজ]১০৯ তার মতে, এই রাজনীতির ধর্ম একটি সেক্যুলার ধর্ম। Gentile রাজনীতির ধর্মকে দুইভাবে ভাগ করেছেন- ১. রাজনৈতিক ধর্ম (Political Religion) এবং ২. নাগরিক ধর্ম (Civil Religion)। তার ভাষায়, রাজনৈতিক ধর্মের উদাহরণ হচ্ছে টোটালিটারিয়ান রেজিমগুলো, আর নাগরিক ধর্মের উদাহরণ হচ্ছে ডেমোক্র্যাটিক রেজিমগুলো। ১১০
ক্যাভানগ অন্যান্য স্কলারদের উদ্ধৃত করে বলছেন যে, পশ্চিমে রাজনৈতিক ধর্মের সবচেয়ে বড় উদাহরণ হচ্ছে, মার্ক্সিজম/কম্যুনিজম এবং ফ্যাসিজম। ১১০ যেমনটা Max Stiner বলেছেন যে, অন্যান্য ধর্মে ইশ্বর বা মূর্তিকে যে সম্মানের স্থানে বসানো হয়, কম্যুনিজম মানুষেকে সেই উচ্চতায় বসিয়ে দিয়েছে। ১১১ Joseph Schumpeter তার Capitalism, Socialism and Democracy বইয়ের “Marx as Prophet” অধ্যায়ে বলছেন যে, “… মার্ক্সিজম একটি ধর্ম। কারণ তার বিশ্বাসীদের কাছে এটা প্রথমত, একটা এমন একটা চূড়ান্ত ব্যবস্থা— যার মধ্যে জীবনের অর্থ নিহিত আছে এবং যে ব্যবস্থা আসলে মানুষের ঘটনা ও কর্যাবলীকে বিচার করার একটা পরম মানদন্ড (ultimate standard)। দ্বিতীয়ত, এটা হচ্ছে পৃথিবী থেকে খারাপকে শেষ করে দেওয়ার মাধ্যমে মানবজাতিকে অথবা মানবজাতির একটা বাছাইকৃত অংশকে বাঁচানোর দিকনির্দেশনা (Guide)। আর মার্ক্সিস্ট সোশ্যালিজম তো আরেকধাপ এগিয়ে পৃথিবীর বুকেই বেহেশতের প্রতিশ্রুতি দেয়।” [প্যারাফ্রেইজ]। আবার বিখ্যাত মার্ক্সিস্ট Antonio Gramsci-ও মার্ক্সিজমকে ধর্ম বলেছেন; কারণ তার ভাষায়, “[মার্ক্সিজম]ও একটি তার নিজস্ব গোপন মতবাদ (Mysteries) ও আচার সম্বলিত একটি বিশ্বাস, কারণ এটা আমাদের চিন্তায় ক্যাথোলিসিজমের অতীন্দ্রীয় ইশ্বরের জায়গায় মানুষের উপর বিশ্বাস এবং তার [মানুষের] সক্রিয়তাকে একমাত্র আত্মিক বাস্তবতা (Spiritual Reality) হিসেবে প্রতিস্থাপিত করেছে।”১১২
আবার নাগরিক ধর্ম হিসেবে ডেমোক্র্যাসি, ন্যাশনালিজমকে বিশ্লেষণ করলে দেখা যায় যে, এগুলো ধর্মের সংজ্ঞায়নের মাপে অনেক ট্রেডিশনাল ধর্মকেও ছাড়িয়ে গেছে। ক্রিশ্চিয়ানিটির বিভাজনবাদী প্রভাবের নিরাময় হিসেবে Jean-Jacques Rousseau এর প্রস্তাবিত সেক্যুলার নাগরিক ধর্ম আধুনিক জাতিরাষ্ট্রের ধর্মীয় আচার-অনুষ্ঠানে (cult) পরিনত হয়েছে। এই নাগরিক ধর্মের ট্রেডিশনাল ধর্মের মতোই কিছু মতবাদ বা অনুশাসন রয়েছে, যা নাগরিকরা মানতে বাধ্য; অন্যথায় তার জন্যে রয়েছে গুরুতর শাস্তি। যেমনটা রুশো বলছেন, নাগরিক হিসেবে রাষ্ট্রের মতবাদ ও অনুশাসনের উপর কেউ অবিশ্বাস রাখলে তার শাস্তি হওয়া উচিত মৃত্যুদন্ড; কারণ, এটা সবচেয়ে বড় অপরাধ। ১১৫ ১৭৮৯ সালের ফরাসী বিপ্লবের পর ফ্রান্সে রুশোর এই নাগরিক ধর্মের আইডিয়াকে অনেকেই মনে-প্রাণে গ্রহন করে ফ্রেঞ্চ জাতির নিজস্ব একটা আচার-অনুষ্ঠান তৈরি করা চেষ্টা করেছিলেন। ১৭৯১ সালের পরে ফ্রান্সে ক্যাথোলিসিজমকে বেশ ভালো ভাবে দমন করা হয় এবং এর বদলে ফ্রান্সের প্রতি আনুগত্যশীল একটা কাঠামো ও আচার-অনুষ্ঠান তৈরির প্রচেষ্টা চালানো হয়েছিলো। ১১৫
Carlton J.H. Hayes তার Nationalism as a Religion প্রবন্ধে বলছেন যে, পশ্চিমে পাবলিক ক্রিশ্চিয়ানিটির পতনের সাথে সাথে জাতির সেক্যুলারাইজেশনের মাধ্যমে সেই শুণ্যস্থান পূরণ করা হয় এবং জাতি-রাষ্ট্রের অনুগত্য মানুষের উপাসনার মূল কেন্দ্র হিসেবে পরিবর্তিত হয়। ১১৪ Bendict Anderson ন্যাশনালিজম সম্পর্কে বলছেন যে, ন্যাশনালিজম মানুষকে নতুন ধরনের মুক্তির (salvation) সন্ধান দেয়। ফলে দেশের জন্য জীবন দেওয়া অনেক মহৎ একটি কাজ হিসেবে বিবেচিত হয়। ১১৪
আবার আমেরিকায় নাগরিক ধর্মের উত্থান হয় আলোকায়ন এবং খ্রীষ্টীয় ভাব ও প্রতীকের মিশেল হিসেবে। Gentile এটাকে বলছেন যে, এটা ছিলো ট্রেডিশনাল ক্রিশ্চিয়ানিটি থেকে আমেরিকার (United States) নিজের দিকে “পবিত্রতার ধারণার পরিবর্তন” (Transfer of Sacredness)। ১১৫ আমেরিকার এই নাগরিক ধর্ম কেবল আমেরিকার জন্যই নয়, বরং পুরো পৃথিবীর জন্যই “Messiah” বা ত্রাতা হিসেবে আবির্ভূত হয়। আর সে এই ত্রাতার দায়িত্ব পালন করে পুরো পৃথিবীব্যাপী তার গণতন্ত্র, মুক্তি (Freedom) ও উন্নয়ন (Progress) ছড়িয়ে দেওয়ার মাধ্যমে। ১১৬ Rober Bellah এর Civil Religion in America আর্টিকেলের বরাত দিয়ে ক্যাভনগ আরো বলছেন যে, আমেরিকায় চার্চ ও রাষ্ট্রের পৃথকীকরণ আসলে ধর্ম ও রাষ্ট্রের পৃথকীকরণ ছিলোনা। সেখানে শুধুমাত্র ট্রেডিশনাল ধর্মের প্রাইভেটাইজেশন হয়েছে, কিন্তু নাগরিক/রাজনৈতিক ধর্ম পাবলিক স্ফিয়ারে ক্ষমতার কেন্দ্রবিন্দু হিসেবে সচল। ১১৫ Hayes বলছেন যে, আমেরিকান নাগরিক ধর্মের সাধু হচ্ছেন তার Founding Fathers, তীর্থস্থান হচ্ছে Independece Hall, পবিত্র স্মৃতিচিহ্ন হচ্ছে Liberty Bell, পবিত্র গ্রন্থ হচ্ছে স্বাধীনতার ঘোষণা ও সংবিধান, এর ক্রিসমাস হচ্ছে ৪ জুলাই, এর feast of corpus Christi হচ্ছে পতাকা দিবস। তিনি আরো বলছেন যে, “ন্যাশনালিজমের বিশ্বাসের প্রধান প্রতীক এবং উপাসনার কেন্দ্রবিন্দু হচ্ছে পতাকা। আর এটাকে উপাসনার পদ্ধতি হচ্ছে, পতাকাকে স্যালুট দেওয়া। … মানুষ পতাকাকে টুপি খুলে স্যালুট দেয়, পতাকার প্রশংসায় কবিরা কবিতা লেখে, শিশুরা স্তুতি গায়।… তারপর পতাকার সামনে দাঁড়িয়ে পতাকা ও দেশের আনুগত্যের প্রতি অঙ্গীকার করে।” ১১৭
পশ্চিমা স্কলারদের ধর্মের সংজ্ঞায়নের অসারতা ও ফাঁক বুঝতে উপরোক্ত উদ্ধৃতি ও ব্যাখ্যাগুলো আশা করি যথেষ্ট। এই উদ্ধৃতি ও ব্যাখ্যাগুলো সব পশ্চিমা স্কলারদের থেকেই থেকেই নেয়া হয়েছে, তারাই আমাদের দেখাচ্ছেন যে, ধর্মের এ ধরণের পশ্চিমা সংজ্ঞায়ন কিরকম স্ববিরোধী এবং ফাঁক-ফোকরে ভরপুর। ধর্মীয় সন্ত্রাসের মিথকে জনপ্রিয় করতে পশ্চিমা স্কলাররা সুবিধেমত ধর্মের বিভিন্ন সংজ্ঞা এনে হাযির করেছেন, যা অনেকাংশেই স্ববিরোধী। সুতরাং ধর্ম সহিংসতা প্রবণ— এই মিথকে প্রমাণ করতে ধর্মের সে সংজ্ঞায়ন ও ক্যাটাগরাইজেশন তা আসলে ধোপে টিকেনা; কারণ বৈশিষ্ট্য ও কর্মপদ্ধতির দিক থেকে অনেক সেক্যুলার মতবাদ/ফেনোমেনা ও অনেক ট্রেডিশনাল ধর্মের মধ্যে কন পার্থক্য নেই আদতে। সংজ্ঞায়নের ক্ষেত্রে ধর্মকে ট্রেডিশনাল ধর্মের ক্যাটাগরিতে বৃত্তবন্দী করতে না পারলে, কেবল ট্রেডিশনাল ধর্মগুলোই সহিংসাপ্রবণ— এই দাবি তার যৌক্তিকতা হারায়। কিন্তু তারপরেও পশ্চিমা ধর্মীয় সহিংসতা নিজে কাজ করা বেশিরভাগ স্কলাররাই ধর্মের সংজ্ঞায়নের সীমাবদ্ধতার সমাধান না করেই সহিংসতার জন্য এককভাবে ধর্মকে দায়ী করে যাচ্ছেন।